রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার পূর্ব রমাকান্ত গ্রামের কৃষক রেজাউল ইসলাম। স্থানীয় সমিতি ও সুদ কারবারিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবাদ শুরু করেন। কিন্তু পরপর দুই বছর লসের মুখে পড়েন তিনি। টাকা শোধ দিতে না পারায় চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে সুদ। দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে শুধু লাভই পরিশোধ করেন এর দ্বিগুণ।
একপর্যায়ে পাওনাদারদের চাপে পরিবার নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তিনি। এখন রাজধানীর একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করে সেই ঋণের টাকা পরিশোধ করছেন।
একই এলাকার আরেক কৃষক দবিয়ার ইসলাম। কয়েকজন মিলে তিস্তার চরে মিষ্টিকুমড়ার চাষ করেন। আবাদের খরচ জোগাতে তিনিও শরণাপন্ন হন সুদ কারবারিদের কাছে। আড়াই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খাটান আবাদের পেছনে। কিন্তু ওইবার আবাদে লস হওয়ায় ঋণের জালে পড়েন তিনি। পাওনাদারদের চাপে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। পরে টাকা আদায় করতে পাওনাদাররা তার বৃদ্ধ বাবার ওপর চালান শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে আবাদি জমি বন্ধক ও গরু বিক্রি করে তাদের টাকা পরিশোধ করলেও, এখনো অনেক টাকার ঋণ।
শুধু রেজাউল ও দবিয়ার নন, সুদের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে তাদের মতো বাড়িছাড়া হয়েছেন এরশাদ, আব্দুর রাজ্জাক, আইয়ুব আলীসহ এ এলাকার অন্তত ৭০ জন মানুষ। যাদের বেশিরভাগই কৃষক।
দাদনের টাকা দিতে না পারায় গরু নিয়ে গেলেন শ্রমিক নেতা
কৃষক রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘সুদ খুব খারাপ জিনিস বাহে। ঋণ নিয়ে আবাদ করছিলাম; কিন্তু আবাদে লস হয়ে যায়। ২ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা যে পরিশোধ করছি, তার হিসাব নাই। এখনো দেড় লাখ টাকা ঋণ। এটা শোধ করতে করতে সুদসহ ২ লাখ বা তার বেশি দেওয়া লাগবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাধ্য হয়ে পরিবার নিয়া বাড়ি থেকে পালিয়েছি। টাকা পরিশোধ করতে ছোট ছেলে-মেয়েরাও গার্মেন্টসে চাকরি করছে। রোজগার করে টাকা পরিশোধ করে আবার গ্রামে ফিরে আসতে চাই। ঢাকায় আর ভালো লাগে না বলতে বলতেই চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে।’
দবিয়ার ইসলাম বলেন, ‘লাভের ওপর টাকা নিয়ে আবাদ করছি, কিন্তু সেই আবাদে লস হইছে। সুদ কারবারিদের চাপে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘোড়াশালে গেছি। ওরা আমার বাবাকে অপমান করছে, পরে জমি বন্ধক রেখে, গরু বিক্রি করে ওদের আসল টাকা শোধ করলেও এখনো লাভের টাকা পাবে।’
প্রতি বছর দফায় দফায় বন্যার কবলে পড়ে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েন তিস্তা অববাহিকার এই গ্রামের কৃষক। ক্ষতিগ্রস্ত অনেক কৃষক এলাকার মহাজন ও বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন। বছরের পর বছর গেলেও তারা ঋণের জাল থেকে বের হতে পারেননি।
স্থানীয় কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের সুদের বিনিময়ে ঋণ দেন এ এলাকার কিছু সুদ কারবারি ও নামে-বেনামে গড়ে ওঠা ক্লাব ও সমিতি। ঝামেলা ছাড়া সহজেই ঋণ পাওয়ায় তাদের কাছেই যান মানুষ।
কয়েকজন দাদন গ্রহীতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিভিন্ন মেয়াদ ও লাভে ঋণ দেন সুদের কারবারিরা। মাসিক, সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক ভিত্তিতেও ঋণ দেন তারা। মাসিক হিসাবে ১০ হাজার টাকা নিলে মাসে ১ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। প্রতি সপ্তাহ মেয়াদে নিলে হাজার প্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা লাভ দিতে হয়। আর বিশেষ প্রয়োজনে দৈনিক মেয়াদের হিসেবে ১ হাজার টাকায় দিনে ১০০ টাকা সুদ দিতে হয়। এ ছাড়া মৌসুমি ধানের হিসাবে এক লাখ টাকা নিলে বোরো মৌসুমে ২০ মণ ধান ও আমন মৌসুমে ১০ মণ ধান দিতে হয়।